চতুর্থ পরিচ্ছেদ মৎস্য ক্ষেত্রের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - কৃষিশিক্ষা - কৃষি ও জলবায়ু | | NCTB BOOK
1

পুষ্টির চাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তথা বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে । অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয় । আর মাছ চাষের ক্ষেত্রে এদেশের অবস্থান পঞ্চম। এদেশের নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর, পুকুর, দিঘি, প্লাবন ভূমি ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ের মোট পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন হেক্টর । সেই সাথে আরও রয়েছে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের বিশাল সামুদ্রিক এলাকা । দেশের এই সকল জলভাগ থেকে বর্তমানে যে মৎস্য উৎপাদন হয় তা এদের আয়তনের তুলনায় যথেষ্ট নয় । এ থেকে আরও অনেক বেশি উৎপাদন সম্ভব । বাংলাদেশে ২০১১-১২ সালে যেখানে মাছের উৎপাদন ছিল প্রায় ৩২.৬২ লক্ষ মেট্রিক টন । সেখানে সরকারের রূপকল্প ২০২১ অনুযায়ী ২০২০-২০২১ সাল নাগাদ মৎস্য উৎপাদনের লক্ষ মাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫.৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। যদিও দেশে মাছের উৎপাদন বিগত বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে । কিন্তু এটি বেড়েছে মাছ চাষ বৃদ্ধির ফলে । অথচ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় যেমন-নদী, খাল, বিল, হাওর প্লাবনভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে । সেখানে কমে যাচ্ছে মাছের জীববৈচিত্র্যও । আর এর অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ুর পরিবর্তন । জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনাবৃষ্টি বা অপর্যাপ্ত বৃষ্টি হচ্ছে । বেড়ে যাচ্ছে সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা ও সংখ্যা । এ সমস্ত কারণে মাছ চাষ, মাছের স্বাভাবিক প্রজনন ও বিচরণ ব্যাহত হচ্ছে। নিচে মৎস্য ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আলোচনা করা হলো-

ক) মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদনে প্রভাব

১) আমাদের দেশে মৌসুমি পুকুরগুলোতে এপ্রিল-মে মাসে বৃষ্টির পানি জমলে চাষিরা মাছ ছাড়ে । জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমে গেছে । অথবা বৃষ্টিপাত শুরু হতে দেরি হচ্ছে । এতে করে পোনা ছাড়তে দেরি হচ্ছে । আবার দেরিতে পোনা ছাড়ার পর পুকুর শুকিয়েও যাচ্ছে তাড়াতাড়ি । ফলে চাষের সময় কমে যাচ্ছে এবং মাছ বড় হওয়ার আগেই ছোট মাছ বাজারজাত করতে হচ্ছে। এতে করে চাষিরা লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে।

২) জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কম বৃষ্টিপাতের ফলে হ্যাচারিতে মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে । প্রজননের অনুকূল পরিবেশ না পাওয়া ও তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণে হ্যাচারিতে মাছ কৃত্রিম প্রজননে সাড়া দিচ্ছে না। পেটে ডিম আসলেও ডিম ছাড়ছে না । ডিম শরীরে শোষিত হয়ে যাচ্ছে । আবার মাছ ডিম ছাড়লেও তা নিষিক্ত হচ্ছে না বা কম হচ্ছে। আবার নিষিক্ত হওয়া ডিম ফোটার হারও কম হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন এভাবে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন ব্যাহত করছে।

৩) স্বল্প গভীর পুকুরে অধিক তাপমাত্রায় মাছ সহজে রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে । ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে ও চাষিদের আয় কমে যাচ্ছে ।

৪) কম বৃষ্টির কারণে চাষের পুকুরে কম পানি পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পুকুরে বা খামারে পানি সরবরাহে চাষিকে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে ।

৫) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা এবং সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে । ফলে মৎস্য সেক্টরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে চাষিদের দুর্ভোগ বাড়ছে । পুকুর থেকে মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে।

৬) সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের চাষের পুকুরগুলো ডুবে যেতে পারে ।

খ) অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনে প্রভাব

১) কম বৃষ্টিপাতের ফলে নদীতে কম পানি হচ্ছে ফলে অল্প পানিতে সহজেই মাছ ধরা সম্ভব হচ্ছে । এতে করে ছোট-বড়, প্রজননক্ষম সব মাছ ধরা পড়ছে । ফলে নদীতে মাছের জীববৈচিত্র্য ও স্থায়ী উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

২) তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে ফলে লবণাক্ততা ঢুকে পড়ছে মূল ভূ-খণ্ডের দিকে। এতে করে উপকূলীয় এলাকার স্বাদুপানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র কমে যাচ্ছে । সেই সাথে কমে যাচ্ছে উৎপাদনও ।

৩) আমাদের দেশে বিল, বাঁওড়, প্লাবন ভূমিতে এপ্রিল-মে মাস হচ্ছে দেশীয় জাতের ছোট মাছের প্রজননকাল । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় বা কম হওয়ার কারণে জুলাই মাস পর্যন্তও এসব জলাশয়ে পানি হচ্ছে না। ফলে এসব মাছের প্রজনন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । ফলে এর প্রভাব পড়ছে সমগ্র মৎস্য উৎপাদনে এবং যারা মাছ আহরণ করে তাদের পুষ্টি ও জীবীকার ক্ষেত্রে।

৪) আমাদের দেশে একমাত্র হালদা নদীতে প্রাকৃতিকভাবে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে। বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড গরমের পর ভারী বৃষ্টি শুরু হলে এরা ডিম ছাড়ে । তখন নদী থেকে জেলেরা নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করে এবং এই ডিম ফুটিয়ে পোনা উৎপাদন করে। জলবায়ুর পরিবর্তনে তাপমাত্রার বৃদ্ধির ফলে ব্রুডমাছের ডিমের পরিপক্বতা এগিয়ে আসছে । অন্যদিকে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার সময় দিন দিন পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে করে মাছের শারীরবৃত্তীয় অবস্থার সাথে বৃষ্টিপাতের সময়ের অমিল হচ্ছে। ফলে ডিম পাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছে ।

গ) সামুদ্রিক মৎস্য ক্ষেত্রে প্রভাব

১) বায়ুমণ্ডলে দিন দিন কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে ফলে বেড়ে যাচ্ছে বাতাসের ও সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা । ফলে বাতাসের গতি প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে, বৃষ্টির ধরন পরিবর্তন হচ্ছে । এতে করে সাগরে মাছের বিচরণ ও উৎপাদশীলতায় প্রভাব পড়ছে । ফলে সমুদ্রের কোনো অংশে মাছের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে । আবার মাছের নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র বলে খ্যাত কিছু এলাকা মাছশূন্য হয়ে যেতে পারে ।

২) বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে মাছ উষ্ণ মণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের সাগরের দিকে সরে যাচ্ছে। অনেক মাছ তার অভিপ্রায়ন (migration) পথ, প্রজননক্ষেত্র এবং বিচরণক্ষেত্র পরিবর্তন করে ফেলছে । ফলে জেলেরা সুদূর অতীত থেকে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সমুদ্রের যে সব সামুদ্রিক এলাকায় মাছ আহরণ করতে যেত সেগুলোর পরিবর্তন হলে জেলেরা বিপাকে পড়বে ।

৩) কোরাল রীফ বা প্রবাল সামুদ্রিক মাছের উৎকৃষ্ট আবাসস্থল, যেখানে বিভিন্ন ধরনের মাছ বাস করে এবং প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহার করে । পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি, ঢেউয়ের তারতম্য, সমুদ্রের অম্লত্ব বৃদ্ধি, দূষণ, স্রোতের গতি পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রবাল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র তথা মৎস্য বৈচিত্র্যের উপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে ।

কাজ : শিক্ষার্থীরা মৎস্য ক্ষেত্রের উপর জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে প্রতিবেদন লিখবে ।


 

 

Content added By
Promotion